মাদরাসায় যেসমস্ত অনুদান গ্রহন করা হয় সাধারণ দান  যাকাত সাদাকাত  কোরবানীর চামড়া ও উহার মূল্য  >>

আলমে বারযাখ [কবরের জগৎ]

আলহাজ্ব ডা. মোঃ সোহরাব হাসান

আমরা সকলেই বিশ্বাস করি, মানুষ মরণশীল। (Man is Mortal.) জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জীবন- এই তিনটি কথা যেমন সত্য, তেমনি তিনটি কালও সত্য- ইহকাল, পরকাল ও আলমে বারযাখ। আলমে বারযাখ বা কবর জগৎ সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই অজানা।

মানুষের মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আলমে বারযাখ বলে। বারযাখ শব্দের অর্থ: দুই বস্তুর মধ্যকার অন্তরাল। শরীয়তের পরিভাষায় মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মধ্যবর্তী সময়টিকে বারযাখ বলা হয়। যে যেভাবেই মৃত্যুবরণ করুক না কেন, সে বারযাখে প্রবেশ করে। চাই তাকে স্বাভাবিকভাবে কবরস্থ করা হোক বা না হোক। সুতরাং, যে কেউ হিংস্র জন্তুর খাবারে পরিণত হলো, বা আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ছাই হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলো, তারও পুনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত সময়টি বারযাখ। পবিত্র কুরআনে বারযাখের আলোচনা এসেছে। ইরশাদ হচ্ছে- “এবং তাদের (অর্থাৎ মৃতদের) সামনে রয়েছে বারযাখ, যা তাদেরকে পুনরুত্থিত করার দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।”সূরা আল মুমিনুন, আয়াত: ১০০।

মানুষ মারা যাওয়ার পর মানুষের রূহ দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভালো মানুষের রূহগুলো ইল্লিয়‌্যিীনে নিয়ে যাওয়া হয়। কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- অর্থ: “জেনে রেখো, নেককারদের আমলনামা থাকে ইল্লিয়‌্যীনে।” সূরা মুতাফফিফীন , আয়াত: ১৮। ইল্লিয়্যীন-এর শাব্দিক অর্থ অট্টালিকা। মুমিনদের রূহ যেখানে নিয়ে রাখা হয়, এটা সেই স্থানের নাম। তাদের আমলনামাও এখানেই হেফাজত করা হয়।  আর খারাপ মানুষের রূহগুলো সিজজীনে নিয়ে যাওয়া হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- অর্থ: নিশ্চয় পাপিষ্ঠদের আমলনামা আছে সিজজীনে। তুমি কি জানো, সিজজীন কী? তা লিপিবদ্ধ খাতা।” সূরা মুতাফফিফীন, আয়াত: ৮-৯। সিজজীন এর শাব্দিক অর্থ কারাগার,এটা সে স্থানের নাম,কাফেরদের মৃত্যুর পর তাদের রূহ যেখানে নিয়ে রাখা হয় এবং সেখানেই তাদের আমলনামাও সংরক্ষিত রাখা হয়। 

মৃত্যুর পর রূহের গন্তব্য কোথায়-এর বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় হাদীস শরীফে। একটি দীর্ঘ হাদীসে এসেছে,  মুমিনের মৃত্যুর পর তাঁর রূহকে নিয়ে ফিরিশতাগণ সর্বোচ্চ সম্মান ও যত্নসহকারে  আকাশের দিকে রওয়ানা হন। যখনই কোন ফিরিশতাদলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, তাঁরা জিজ্ঞেস করেন এই পবিত্র রূহটি কার? তখন ফেরেশতাগণ দুনিয়ায় ডাকা সর্বাধিক সুন্দর নামটি উল্লেখ করে বলেন, অমুকের পুত্র অমুক। প্রথম আকাশে পৌঁছার পর অনুমতি চাইলে দরজা খুলে দেয়া হয়। সেখানকার নিকটবর্তী ফিরিশতাগণ বিদায় জানাতে তাদের সঙ্গে পরবর্তী আকাশ পর্যন্ত সঙ্গে যান। অবশেষে সপ্তম আকাশ পর্যন্ত পৌঁছান। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা আমার বান্দার নাম ইল্লিয়‌্যীনে লিখে দাও এবং তাঁকে যমীনে ফিরিয়ে নাও। কেননা তা থেকেই আমি তাদেরকে সৃষ্টি করেছি। তাতেই তাদেরকে ফিরিয়ে নেব। পুনরায় তা থেকেই তাদেরকে জীবিত করবো। অত:পর সেই রূহকে কবরে রাখা শরীরে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এরপর দুজন ফিরিশতা এসে কবরে তাকে সুওয়াল-জওয়াব করেন।

কাফেরের মৃত্যুর পর তার রূহকে নিয়ে ফেরেশতাগণ সর্বোচ্চ অপমানসহকারে আকাশের দিকে রওয়ানা করেন। যখনই কোন ফিরিশতাদলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, তাঁরা জিজ্ঞেস করেন, এই নিকৃষ্ট রূহটা কার? দুনিয়ায় ডাকা সবচেয়ে নিকৃষ্ট নামটা উল্লেখ করে ফিরিশতাগণ জবাব দেন- অমুকের ছেলে অমুক। এভাবে দুনিয়ার আকাশ পর্যন্ত পৌঁছানো হয়। অকাশের দরজা খোলার অনুমতি যখন চাওয়া হয়, তখন তা খোলা হয় না। এখানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা আরাফ এর ৪০নং আয়াত তিলাওয়াত করেন। অর্থ : ‘তাদের জন্য আকাশের দরজা খোলা হবে না। এবং তারা বেহেশতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না সুঁইয়ের ছিদ্রে উট প্রবেশ করবে।’ অত:পর আল্লাহ তাআলা বলেন : এর নাম সিজ্জিনে লিখে দাও। তখন তার রূহকে সজোরে নিচের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। অত:পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা হজ্জ এর ৩১ নং আয়াত তিলাওয়াত করেন। অর্থ : ‘যে কেউ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পতিত হল, তারপর পাখি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’

অত:পর তার রূহকে কবরে রাখা শরীরে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এরপর দুইজন ফেরেশতা এসে সুওয়াল-জওয়াব শুরু করেন।

সুওয়াল-জওয়াবের পর পুনরুত্থান পর্যন্ত রূহ কোথায় অবস্থান করে? এ প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেয়া  প্রায় অসম্ভব। আমলের বিচারে সকল রূহ যেমন এক পর্যায়ের নয়, তেমনি সব রূহের অবস্থানও এক জায়গায় নয়। নবী- রসূলগণের রূহ অবস্থান করে উর্ধ্ব জগতে “আলা ইল্লিয়্যিন তথা ইল্লিয়্যিনের সর্বোচ্চ স্তরে। শহিদগণের রূহ সবুজ পাখিকে বাহন বানিয়ে জান্নাতের যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ায় । কারো রূহ জান্নাতে দরজায় অবস্থান করে।

বদকারদের রূহও মাটির অতল গহ্বরে নানারকম  অবস্থানে থাকে। যেমন ব্যভিচার নর-নারীর রূহ চুল্লিতে দগ্ধ হতে থাকে। সুদখোরদের রূহ রক্তের নদীতে সাতার কাটতে থাকে এবং তাদের মুখে বারবার পাথর নিক্ষিপ্ত হতে থাকে।

রূহের অবস্থান উর্ধ্বজগতে কিংবা মাটির অতল গহ্বরে যেখানেই থাকুক না কেন, এর একটি সম্পর্ক কবর ও শরীরের সঙ্গে বিদ্যমান থাকে এবং এই রূহ স্থানান্তর ও গমনাগমনের ক্ষেত্রে ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন হয়ে থাকে।

 নেককারগণের কবর জান্নাতের বাগান হবে এবং তারা সেখানে জান্নাতের নেয়ামতরাজি ভোগ করবেন। পক্ষান্তরে বদকারদের কবর জাহান্নামের টুকরা হবে এবং তারা সেখানে নানান রকম শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। এসব বিষয়ে হাদীস শরীফে অনেক বর্ণনা এসেছে। এখানে আমাদের মনে রাখা দরকার, নেককার বা বদকার ব্যক্তি এই নেয়ামত বা শাস্তি ভোগ করবে Subconscious Mind (অবচেতন মন) দ্বারা। অর্থাৎ এই সময়ে তাদের মনের উপলব্ধি শক্তি কার্যকর থাকবে, তবে কোন Responce করতে পারবে না।

এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। কিয়ামতের ‍চূড়ান্ত বিচারের আগে কবরের সাজা ভোগের যুক্তি কী? এর জবাব হল, কবর হচ্ছে আখেরাতের প্রথম ঘাঁটি। চূড়ান্ত বিচারের পূর্বেই অপরাধীদেরকে এখানে কিছু নমুনা শাস্তি প্রদান করা হয়ে থাকে, যেমন নেককারদেরকে নেয়ামত প্রদান করা হয়ে থাকে। দুনিয়াতে এর একটি সহজ দৃষ্টান্ত হচ্ছে, কোন কুখ্যাত অপরাধী যদি জেলে বন্দী থাকে, তাহলে চূড়ান্ত বিচারের আগেও তাকে বন্দীদশায় নানা রকম কষ্টে রাখা হয়। নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয়। অসম্মানজনক আচরণ করা হয়। যদিও এখনো তার চ‚ড়ান্ত বিচারের রায় প্রদান করা হয়নি। রায় প্রদানের পরেই তার আসল শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। এর বিপরীতে কোন কীর্তিমান মানুষ যখন কোন অপরাধের অভিযোগে আটক হন, তাকেও প্রাথমিভাবে জেলে রাখা হয়। কিন্তু সেখানে তার সঙ্গে তার কীর্তির কারণে সম্মানজনক আচরণই করা হতে থাকে, ভালো মানের খাবার দেওয়া হয়ে থাকে। জেলের কর্মীগণ তাকে সালাম-স্যালুটও দিতে থাকে। তারও বিচারের রায় কিন্তু পরেই হবে। এসবই হচ্ছে চ‚ড়ান্ত বিচারের আগে।

 অবশ্য দুনিয়ার বিচারের দৃষ্টান্ত আখেরাতের সঙ্গে পুরোপুরি মিলবে না। কারণ, দুনিয়াতে অনেক সময় নিরাপরাধ মানুষকেও দোষী অপবাদে আটক করা হয়। সাজাও প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে আবার নির্দোষও প্রমাণিত হয়। কিন্তু আল্লাহর বিচারে এমন কিছুর আশঙ্কা নেই। আল্লাহ পাক বান্দার পূর্বাপর সবই জানেন। সুতরাং, কেয়ামতের চূড়ান্ত বিচারে যে অপরাধী সাব্যস্ত হবে, কেবল তাকেই কবরে শাস্তি দেওয়া হয়। আর যিনি শেষ বিচারে মুক্তিপ্রাপ্ত সাব্যস্ত হবেন, তার কবরকে জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দেওয়া হয়। কবর আখেরাতের প্রথম ঘাঁটি হওয়ার অর্থ এটিই।

 লেখক: মুতাওয়াল্লি, বাইতুস সালাম মসজিদ-মাদরাসা কমপ্লেক্স, উত্তরা, ঢাকা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *