মাদরাসায় যেসমস্ত অনুদান গ্রহন করা হয় সাধারণ দান  যাকাত সাদাকাত  কোরবানীর চামড়া ও উহার মূল্য  >>

বাইতুস সালাম মসজিদ-মাদরাসা কমপ্লেক্সের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

এডভোকেট মোঃ মিজানুর রহমান

বর্তমানে যেখানে বাইতুস সালাম মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্স রয়েছে, এই এলাকাটি পূর্বে একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল। দক্ষিণখান মৌজাধীন এই গ্রামের নাম ছিলো ঈরশাল। এই গ্রামে কোন মসজিদ-মাদরাসা ছিল না।

এই জমির মালিক ছিলেন মরহুম হাজী আহসান উল্লাহ সাহেব। তাঁর পিতার নাম ছিল লবাই মাতব্বর। হাজী আহসান উল্লাহ ছিলেন লবাই মাতব্বরের একমাত্র ছেলে। হাজী আহসান উল্লাহ সাহেবের ছিল ৩ ছেলে। হাজী আমান উল্লাহ, মোঃ হাবিব উল্লাহ ও হাজী আজীজ উল্লাহ উরফে আজীজ উর রহমান। এই জমিতে তার নিজস্ব বসতবাড়ি ছিল। বসতবাড়িটি ছিল আশেপাশের তুলনায় উঁচু, দেখতে টিলার মত। চারপাশে লাল মাটির সমতল ভূমি ছিল। এখানে ছিল অনেক কাঁঠাল গাছ। লাল মাটির কাঁঠাল ছিল খুবই সুস্বাদু।

হাজী আহসান উল্লাহ ছিলেন মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্সের চারদিকে বিশাল সম্পত্তির মালিক। এই ঈরশাল এলাকায় তিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি তাবলিগের শুরুর দিকের একজন নিষ্ঠাবান সাথী ছিলেন। তাঁর মুখেই শুনেছি, তারাই প্রথম তাবলিগের ইজতেমা করেছেন নারায়ণগঞ্জে, তারপর টঙ্গীতে। টঙ্গীতে জঙ্গল পরিষ্কার করে ইজতেমার মাঠ তৈরি করতে তাঁরা অনেক সাহায্য করেছেন।

হাজী আহসান উল্লাহ সাহেব নিজ উদ্যোগে ১৯৪৬ সনে নিজ বসতবাড়ি সংলগ্ন দক্ষিণ দিকের জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। নির্মাণকালে মসজিদটির দেয়াল ও মেঝে ছিল মাটির, ছাউনী ছিল টিনের। এই মসজিদের যারা নিয়মিত মুসল্লি ছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরলোক গমন করেছেন। যেমন- হাজী আহসান উল্লাহ ও তাঁর ৩ ছেলে, চামুরউদ্দিন মাতব্বর ও তার দুই ছেলে-মোঃ আয়াত আলী ও মোঃ সাহেব আলী, হাজী তমিজউদ্দিন ও তার ছেলে হাজী আবু বকর সিদ্দিক (মেম্বার), মোঃ আফতাব উদ্দীন (মাস্টার)- পিতা মোঃ মাইন উদ্দীন, হাজী আবদুর রশিদ- পিতা মোঃ ফজর আলী, মোঃ কামাল উদ্দীন, মোঃ আবদুল জাব্বার মুন্শী, মোঃ হাফিজ উদ্দীন, মোঃ ইসহাক আলী প্রমুখ।

এই মসজিদে কখনো কখনো আযান দিতেন ও নামায পড়াতেন- হাজী আহসান উল্লাহ সাহেব ও তার দুই ছেলে- হাজী আমান উল্লাহ ও মোঃ হাবিব উল্লাহ, চামুরউদ্দিন মাতব্বর ও হাজী সোবেদ আলী। আল্লাহ তাঁদের সকলের কবরকে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন।

হাজী আহসান উল্লাহ ১৯৫৩ সালে পানি পথে জাহাজে ৬ মাসের যাত্রাপথ অতিক্রম করে পবিত্র হজ পালন করেন। হজ থেকে ফিরে এসে স্থানীয় ছেলে-মেয়েদেরকে আরবী শিক্ষা দেওয়ার জন্য মসজিদের বারান্দায় একটি মকতব চালু করেন। মকতবের শিক্ষাকার্যক্রম আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত চলত। পরবর্তী কালে মরহুম হাজী আহসান উল্লাহ ১৯৬৫ সনে ঢাকা সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের মাধ্যমে মসজিদের নামে ২ বিঘা জমি ওয়াকফ করে দেন।

১৯৬৪-১৯৬৫ সনে উত্তরা মডেল টাউনের জন্য এই এলাকার জমি ও বাড়ি-ঘর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক হুকুম দখল করা হয়। ১৯৬৮ সনে এই এলাকার অধিবাসীগণ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তৎকালীন ডি.আই.টি বর্তমানে রাজউক এই মসজিদের ওয়াকফকৃত ২ বিঘা জমিও দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই ২ বিঘা জমির মূল্য ছিল ১৯৬৪ সনে ১ লক্ষ ৫৮ হাজার টাকা, যা তৎকালীন ডি.আই.টি নির্ধারণ করে। এই টাকা দিয়ে সেই সময় এই এলাকায় ২০ বিঘা জমি কেনা যেতো। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ও তাঁর উত্তরসূরীদেরকে এর উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন। হাজী আহসান উল্লাহ সাহেব উক্ত দখলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকার দেওয়ানী আদালতে একটি দেওয়ানী মোকদ্দমা দায়ের করেন। দীর্ঘ ৮ বছর মোকদ্দমাটি চলার পর অবশেষে মসজিদের অনুক‚লে রায় ও ডিক্রি হয়।

মাটির মসজিদ থাকাকালীন মরহুম মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফিজ্জী হুযুর রহ. একদিন যাত্রাপথে এই মসজিদে নামায আদায় করেন। নামায শেষে তিনি মরহুম হাজী আহসান উল্লাহ সাহেবের সাথে পরিচিত হন এবং এখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার তামান্না প্রকাশ করেন। পূর্ব থেকেই মসজিদের দক্ষিণ পাশের কামরায় হিফজখানা চালু ছিল। এরই মধ্যে হাজী আহসান উল্লাহ সাহেব এলাকার গণ্যমান্য লোকদের সমন্বয়ে একটি মসজিদ কমিটি গঠন করেন। জনাব এম এম ইউনুসকে সভাপতি, মরহুম লুৎফুর রহমান সাহেবকে সেক্রেটারি এবং জনাব এম এম নূরুল হক, মরহুম হাজী লুৎফুর রহমান, মরহুম আলহাজ্জ এবি সিদ্দিক, মরহুম হাজী আফিল উদ্দিন ভ‚ঁইয়া, মরহুম হাজী আবদুর রশিদ, মরহুম এ টি এম শামসুল হক, মরহুম খলিলুর রহমান, মরহুম হাজী আমান উল্লাহ ও জনাব আজিজ উর রহমান প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে সদস্য করে প্রথম নির্বাহী গঠন করেন। পরবর্তীতে উক্ত কমিটি এখানে একটি কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সনে মরহুম মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফিজ্জী হুযুর রহ. নিজে উপস্থিত থেকে মাদরাসার ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন করেন। তখন মদীনাতুল উলূম নামে মাদরাসার কার্যক্রম করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত নাম পরিবর্তন করে মসজিদের সাথে সমন্বয় করে ‘বাইতুস সালাম মাদরাসা’ নামে কার্যক্রম চালু করা হয়। কাল পরিক্রমায় এই মাদরাসা একটি সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম, যা মাদানী নেসাবের অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাদরাসা হিসেবে সারাদেশে সুপরিচিত।

বর্তমানে মাদরাসার যাবতীয় কার্যক্রম একটি সুরম্য ৫ তলা ভবনে চলমান । মাদরাসার মৌলিক বিভাগ হচ্ছে তিনটি- মকতব, হিফজ ও দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত ৮ বছর মেয়াদী কিতাব বিভাগ। যার প্রথম ৪ বছর মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দা.বা. প্রণীত মাদানী নেসাব ও শেষের ৪ বছর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ এর কারিকুলাম অনুসারে পরিচালিত। চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০২১-২২ ই.) মাদরাসা ও মসজিদের শিক্ষকমÐলী ও স্টাফ সংখ্যা ৪৪ ও ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৪৫৫ জন। এখানে কোরআন-সুন্নাহর ভাষা আরবীর পাশাপাশি বাংলা, উর্দূ ও ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞানেরও পাঠদান করা হয়। তাছাড়া এখানে রয়েছে একটি বিশেষায়িত কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স। কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদেরকে সনদও বিতরণ করা হয়। পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামের নিষ্ঠাবান খাদেম ও সফল দায়ী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রয়েছে নানা কর্মসূচী। এসবের মধ্যে আরবী ও বাংলা বক্তৃতা প্রশিক্ষণ, বাংলা ও আরবী বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং বাংলা ও আরবী সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্যে দু’ভাষায় দুটি নিয়মিত দেয়ালিকা প্রকাশ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

হাজী আহসান উল্লাহ সাহেব জীবিত থাকাকালে এই ওয়াকফ সম্পত্তির মোতাওয়াল্লী ছিলেন (দায়িত্ব পালনের সময়কাল: ১৯৪৬-১৯৯৩)। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে মরহুম হাজী আমানউল্লাহ সাহেব দীর্ঘদিন মোতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন (সময়কাল:১৯৯৩-২০০৬)। এরপর হাজী আহসান উল্লাহ সাহেবের ছোট ছেলে জনাব আজিজুর রহমান এই ওয়াকফ সম্পত্তির মোতাওয়াল্লী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন (সময়কাল: ২০০৬-২০২১)। বর্তমানে ১৪.০৪.২০২১ ইং থেকে এই কমপ্লেক্সের মোতাওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আলহাজ্জ ডা. মোঃ সোহ্রাব হাসান। তিনি হাজী আহসান উল্লাহ সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে মরহুম হাবিব উল্লাহ সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র। মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্সের রয়েছে একটি শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ পরিচালনা কমিটি, বর্তমানে যার সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন জনাব এম আজিজুল হক সাহেব। তিনি পুলিশের সাবেক আইজি ও তত্ত¡াবধায়ক সরকারের ১০জন উপদেষ্টার একজন ছিলেন।

মহান আল্লাহ এই ওয়াকফ সম্পত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত মসজিদ ও মাদরাসার সার্বিক উন্নতি দান করুন। এই মূল্যবান জমি ওয়াকফ করার জন্য হাজী আহসান উল্লাহ ও তাঁর পরিবারবর্গকে আল্লাহ উত্তম বিনিময় দান করুন। সেই সঙ্গে এই কমপ্লেক্সের সাথে যারা জড়িত আছেন এবং সময়, শ্রম ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন ও করছেন, আল্লাহ তাদেরকেও উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন। আল্লাহ হাফেজ।

লেখক: সেক্রেটারি, বাইতুস সালাম মসজিদ-মাদরাসা কমপ্লেক্স, উত্তরা, ঢাকা।